রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎ প্রকল্প

রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎ প্রকল্প

রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎ প্রকল্প

আধুনিক বিজ্ঞানের অবদান বিদ্যুৎ একালের শিল্প ও সভ্যতার প্রাণ। বিদ্যুতের দুর্জয় শক্তিবলে দুর্বার কর্মচাঞ্চল্য জাগে সভ্যতার সর্বস্তরে।

বিদ্যুৎই সহস্র যুগের জড়তা ও অচল-অনড়তার অবসাদ ঘুচিয়ে মানুষের সভ্যতাকে দিয়েছে অভূতপূর্ব গতি।

সে শিল্পকে করেছে উৎপাদনমুখর, কৃষির অনুর্বরতার অভিশাপ খুচিয়ে তাকে করেছে অধিক উৎপাদনশীল, সভ্যতার অনগ্রসরতার জড়তা ঘুচিয়ে দিয়ে তাকে সে পরিয়ে দিয়েছে আধুনিকতার মুকুট।

আমাদের ব্যক্তিজীবনের কাজকর্ম, আরাম-আয়েশ, বিনোদন-সবকিছুর পেছনে রয়েছে বিদ্যুৎ শক্তির অবদান। আধুনিক জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে বিদ্যুৎশক্তিই হলো সাফল্যের চাবিকাঠি।

বিদ্যুতের অভাবে জীবন নিষ্প্রাণ, নিষ্ফল ও অর্থহীন হয়ে পড়ে। তাই রূপপুর পরমাণু বিদ্যুৎকেন্দ্র বাংলাদেশের বিদ্যুৎ উৎপাদন প্রয়াসে নবতর সংযোজন।

পরমাণু বিদ্যুৎ কী ?

পারমাণবিক বিদ্যুৎ প্রকল্প স্থাপনের মাধ্যমে যে বিদ্যুৎ উৎপাদন করা হয়, তা-ই পরমাণু বিদ্যুৎ।

পারমাণবিক উপায়ে প্রক্রিয়াজাত ইউরেনিয়াম কিংবা থোরিয়ামের নিউক্লিয়াস ভেঙে দুটি ক্ষুদ্রতম অংশে বিভক্ত হয়ে শক্তি সৃষ্টি করে এবং নির্গত করে দুটি বা তিনটি নিউট্রন।

এই ফিউশান পদ্ধতিতে চেইন রিঅ্যাকশন সৃষ্টি করা যায়। ফলে এই শক্তি প্রচণ্ড তাপের সৃষ্টি করে, যাকে বিদ্যুতে পরিণত করা যায়।

এ পদ্ধতিতে উৎপাদিত বিদ্যুৎকেই বলা হয় পরমাণু বিদ্যুৎ।

অবশ্যই পড়ুন:

পরমাণু বিদ্যুতের শক্তি

পরমাণু বিদ্যুতের শক্তি এত বেশি যে এক কিলোগ্রাম ইউরেনিয়ামে যে শক্তি, তা দুহাজার পাঁচশত টন কয়লা পোড়ালে যে শক্তি পাওয়া যাবে, তার সমান।

তবে পরমাণু পদ্ধতি খুবই কঠিন, জটিল এবং বিপজ্জনক। এ পদ্ধতি সফলভাবে পরিচালনার জন্য দক্ষ পরমাণু বিজ্ঞানী প্রয়োজন।

১৯৫০ সালের দিকে মার্কিন প্রেসিডেন্ট আইসেন হাওয়ার শান্তির জন্য Atom কর্মসূচি হাতে নেন। ফলে ‘আন্তজাতিক পরমাণু শক্তি সংস্থা’ গড়ে ওঠে।

এর তত্ত্বাবধানে পরবর্তীকালে পরমাণু শক্তির শান্তিপূর্ণ ব্যবহার হয় পরমাণু বিদ্যুৎ উৎপাদনে।

রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎ প্রকল্প পটভূমি

বাংলাদেশ পরমাণু শক্তি কমিশন ১৯৭২ সালে আন্তর্জাতিক আণবিক শক্তি সংস্থার সদস্যপদ লাভ করে।

তারপর থেকে পরমাণু শক্তি সংস্থা নানাভাবে বহুমাত্রিক সাহায্য-সহযোগিতা করে যাচ্ছে বাংলাদেশ পরমাণু শক্তি কমিশনকে।

আমেরিকা, ফ্রান্স, জাপান, চীন, কোরিয়া, তুরস্ক এবং অন্যান্য দেশের সঙ্গে পরমাণু শক্তির শান্তিপূর্ণ ব্যবহারে বাংলাদেশ দ্বিপক্ষীয় চুক্তি করেছে।

১৯৭১ সালে বাংলাদেশের স্বাধীনতা লাভের আগে ও আমাদের দেশের বিজ্ঞানীরা পরমাণু বিদ্যুতের প্রয়োজনীয়তার কথা বলেছেন।

এমন কি পাকিস্তান পরমাণু শক্তি কমিশন ১৯৬১ সালে পারমাণবিক বিদ্যুতের প্রসঙ্কা উল্লেখ করার পর থেকেই বিষয়টি প্রাধান্য পায়।

পাকিস্তানে পারমাণবিক বিদ্যুতের সম্ভাব্যতা পরীক্ষার জন্য ইন্টারনিউক্লিয়ার কোম্পানি এবং গিরস অ্যান্ড হিল ইন করপোরেটেড অব আমেরিকাকে কাজে লাগানো হয়েছিল।

তৎকালীন পাকিস্তান পরমাণু শক্তি কমিশনে তাদের জমা প্রতিবেদনে বলা হয়, পূর্ব পাকিস্তানে পদ্মাতীরবর্তী হার্ডিঞ্জ ব্রিজের পাশে পাবনার রূপপুরে কারিগরি ও অর্থনৈতিক দিক থেকে প্রকল্প গ্রহণ বাস্তবসম্মত।

কিন্তু পাকিস্তান সরকারের নেতিবাচক মনোভাবের কারণে তা হয়নি। বাংলাদেশের স্বাধীনতার পর ১৯৭৩ সালে পারমাণবিক বিদ্যুৎ প্রকল্পের প্রথম সুপারিশ করে ওয়াকিং সুপ।

ফ্রেন্স পাওয়ার রিঅ্যাক্টর এবং জাপানি টারবো জেনারেটর স্থাপন প্রক্রিয়া শুরু করে ১৯৮৪-১৯৮৫ সালে।

এরপর রাশিয়ার সাহায্য প্রস্তাব গ্রহণের পর চেরনোবিল পারমাণবিক দুর্ঘটনা ও আমাদের দেশের পারমাণবিক বিদ্যুৎবিরোধী কিছু বিজ্ঞানীর কারণে তা ভেস্তে যায়।

রাশিয়ার সঙ্গে বাংলাদেশের পরমাণু চুক্তি

বিদ্যুৎ ছাড়া আধুনিক জীবন বলতে গেলে অচল। লেনিন ভবিষ্যদ্বাণী করেছিলেন, বৈদ্যুতীকরণই হবে সোভিয়েত রাশিয়ার সাফল্যের প্রধান উৎস।

বৈদ্যুতীকরণের সাহায্যে শিল্প ও কৃষিক্ষেত্রে সোভিয়েত রাশিয়ার বিস্ময়কর সাফল্যের মধ্য দিয়ে। লেনিনের সেই অবিস্মরণীয় ভবিষ্যদ্বাণী সফল হয়েছে।

মার্কিন পুঁজিবাদের চূড়ান্ত সাফল্যের পেছনেও রয়েছে তার ব্যাপক বৈদ্যুতীকরণের সফলতা। বাংলাদেশ ও বিদ্যুৎ উৎপাদনের কাঙ্ক্ষিত লক্ষ্যে পৌঁছানোর স্বপ্ন দেখছে।

বর্তমানে দেশের মোট জনসংখ্যার শতকরা ৮০ ভাগ বিদ্যুৎ-সুবিধার অধীনে আছে। বিদ্যুৎশক্তি বৃদ্ধির জন্য বর্তমান সরকার ক্ষমতায় আসার পর অনেকগুলো বিদ্যুৎ উৎপাদন কেন্দ্র চালু করা হয়েছে।

পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণের উদ্দেশ্যে সরকার ২০০৯ সালের ১৩মে রাশিয়ার সঙ্গে একটি প্রাথমিক চুক্তি স্বাক্ষর করেছে।

এই চুক্তিতে ১ হাজার মেগাওয়াটের পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণের কথা বলা হয়। এই প্রকল্পের জন্য আনুমানিক ব্যয় ধরা হয়েছে ১৫০ কোটি মার্কিন ডলার।

মস্কোয় বাংলাদেশ ও রাশিয়া পরমাণু জ্বালানির শান্তিপূর্ণ ব্যবহারের ক্ষেত্রে সহযোগিতা কাঠামো চুক্তি স্বাক্ষরিত হয় ২০০৯ সালের ২১ মে।

এভাবে বিদ্যুৎ উৎপাদনে বাংলাদেশের অগ্রগতিরসম্ভাবনা সৃষ্টি হয়।

পরমাণু জ্বালানির সুবিধা ও সম্ভাবনা

বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, পরমাণু জ্বালানির মাধ্যমে কার্বনের নির্গমন কম থাকে, যা পরিবেশের ভারসাম্য নষ্ট করে না।

কয়লা পোড়ানোর ফলে ভারতে এক বছরে কার্বন নির্গমন ২৭৯.৬১ এবং বাংলাদেশে ৮.৮ মিলিয়ন মেট্রিক টন।

পারমানিক বিদ্যুৎ প্রকল্পের সবচেয়ে বড় সুবিধা হলো কম খরচে বেশি বিদ্যুৎ উৎপাদন। এই সুবিধা গ্রহণের মাধ্যমে গ্রামে গ্রামে বিদ্যুৎ পৌঁছে যাবে এবং আলোকিত হবে বাংলাদেশ।

পারমাণবিক জ্বালানির অসুবিধা

পারমাণবিক জ্বালানির সুবিধার পাশাপাশি অসুবিধাও কম নয়। একটি পারমাণবিক চুল্লি স্থাপনের আগে অনেক কিছু ভাবতে হয়।

যে অঞ্চলে চুল্লি স্থাপিত হবে সে অঞ্চলের পরিবেশ, ভূমিকম্পন প্রবণতা, হাইড্রোলজি, জনসংখ্যা, আবহাওয়া, সামরিক স্থাপনাসমূহ ইত্যাদি নিয়ে গভীরভাবে চিন্তা করতে হয়।

তাছাড়া অগ্নিকাণ্ড, বিস্ফোরণ, বিকিরণ ও দুর্ঘটনার কারণে মহাবিপর্যয়ঘটতে পারে। পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্রের পর্যবেক্ষণ ও রক্ষণাবেক্ষণের জন্য আন্তর্জাতিক মানের নিউক্লিয়ার বিশেষজ্ঞ প্রয়োজন।

পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্রে দুর্ঘটনা ঘটলে ক্যান্সারের সংক্রমণ ভয়ঙ্কর হয়ে ওঠে।

দুর্ঘটনাকবলিত অঞ্চলে জন্ম নেওয়া শিশুরা শারীরিক প্রতিবন্ধকতার শিকার হয়। নষ্ট হয় জমির উর্বরতা শক্তি।

পারমাণবিক চুল্লিতে রাসায়নিক বিক্রিয়ার পর সৃষ্ট তেজস্ক্রীয় বর্জ্য জীবজগৎ ও পরিবেশের জন্য খুবই বিপজ্জনক।

জোরদার নিরাপত্তাব্যবস্থা থাকার পরও প্রাকৃতিক ব বিপর্যয় ও কারিগরি সমস্যার কারণে দুর্ঘটনার আশঙ্কা থেকেই যায়।

বিজ্ঞানীরা মনে করেন, পারমাণবিক শক্তির মূল উৎস ইউরেনিয়াম আগামী ৪০ থেকে ৬০ বছর পর পাওয়া যাবে না। তখন পারমাণবিক চুল্লি নির্মাণ অত্যন্ত ব্যয়বহুল হবে।

পারমাণবিক বিদ্যুৎ উৎপাদন

পারমাণবিক শক্তির প্রধান উৎস ইউরেনিয়াম, যা বিদ্যুৎ উৎপাদনেও ব্যবহৃত হয়।

পৃথিবীর মোট উৎপাদিত বিদ্যুতের ১৬ শতাংশ পারমাণবিক কেন্দ্র থেকে আসে। বিশ্বের ৩১টি দেশের প্রায় পাঁচশত পারমাণবিক চুল্লিতে এই বিদ্যুৎ উৎপাদিত হয়।

মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রেরই ১০৪ টি রিয়েক্টর রয়েছে, যেখানে বিদ্যুৎ উৎপাদনের হার ২০ শতাংশ।

ফ্রান্সে মোট উৎপাদিত বিদ্যুতের ৭৮ শতাংশ উৎপাদন করে ৫৯টি রিয়েক্টর। ভারতে ২০টি পরমাণু চুল্লির মধ্যে ১৯টি সচল রয়েছে।

চীন পরমাণু ব্যবস্থায় ৯ হাজার মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদন করছে। পাকিস্তানের উৎপাদিত হচ্ছে ৪২৫ মেগাওয়াট।

বর্তমানে চীন, ভারত ও পাকিস্তানসহ আরো কিছু দেশে পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণাধীন রয়েছে।

উপসংহার

বিশ্বের উন্নত দেশগুলোর উন্নতির পেছনে বিদ্যুতের ভূমিকা সবচেয়ে বেশি। পৃথিবীর দূরত্ব ঘুচিয়ে দিয়েছে বিদ্যুৎ।

জীবনের সর্বক্ষেত্রে দিন দিন বিদ্যুতের চাহিদা বাড়ছে। শিল্পবিকাশে বিদ্যুতের ভূমিকা বিস্ময়কর। অথচ দেশে বিদ্যুৎ সংকট বিদ্যমান।

তাই উন্নয়নের স্বার্থে বিদ্যুৎ উৎপাদনে বর্তমান সরকার ব্যাপক পরিকল্পনা গ্রহণ করেছে। তার মধ্যে রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎ প্রকল্প অন্যতম।

এই প্রকল্প বাস্তবায়িত হলে দেশের চাহিদা মিটিয়ে বিদ্যুৎ রপ্তানিকারক দেশের তালিকায় যুক্ত হবে বাংলাদেশ।

Leave a Comment

Copy link