জেনেনিন বিশ্বকোষ কি বা বিশ্বকোষ কাকে বলে? বিশ্বকোষ মানে কি?
বিশ্বকোষ হলো জ্ঞান-বিজ্ঞানের বিচিত্র বিষয় নিয়ে সংকলিত গ্রন্থ বা গ্রন্থমালা।
এ গ্রন্থে জ্ঞানের সকল শাখায় অনেক বিশেষজ্ঞ লেখকের লেখা সংকলিত থাকে। লেখাগুলো থাকে নিবন্ধ আকারে।
নিবন্ধগুলো যে ভাষায় লেখা হয়, সে ভাষার বর্ণানুক্রমে কিংবা বিষয় নি অনুসারে সাজানো থাকে। একটি বিশ্বকোষ সংকলনে নানা বিষয়ের বিশেষজ্ঞগণ যুক্ত থাকেন।
তাঁদের রচিত নিবন্ধগুলো তাই বিশ্বস্ত ও নির্ভরযোগ্য হিসেবে গণ্য হয়। বর্তমানে বিশ্বকোষের মুদ্রিত রূপ ছাড়াও কম্পিউটারে ব্যবহারযোগ্য রূপও পাওয়া যায়।
বিশ্বকোষ কি বা বিশ্বকোষ কাকে বলে?
জ্ঞান-বিজ্ঞানের বিভিন্ন শাখার আলোচ্য বিষয় নিয়েসংকলিত এবং সাধারণত একাধিক খণ্ডে বর্ণানুক্রমিকভাবে বিন্যাস্ত গ্রন্থ-বিশেষকে বিশ্বকোষ বলে।
বাংলায় বিশ্বকোষ শব্দটি ইংরেজি এনসাইক্লোপিডিয়া শব্দের প্রতিশব্দ।
পৃথিবীর সকল জ্ঞানশাখা বা শৃঙ্খলার বিষয়াবলি এতে স্থান পায়।
বিশ্বকোষে সংকলিত নিবন্ধগুলো সংক্ষিপ্ত হলেও সেগুলো একেকটি বিষয়ের ওপর গভীর ধারণা দেয়।
বিশ্বকোষের বৈশিষ্ট্য
বিশ্বকোষ একটি বৃহৎ কলেবরের গ্রন্থ। উনিশশতকে বাংলা গদ্যের বিকাশের পর ভারতবর্ষে বাংলায় বিশ্বকোষ সংকলন শুরু হয়।
প্রতিটি বিশ্বকোষের কিছু সাধারণ বৈশিষ্ট্য আছে। যেমন:
- বিশ্বকোষে অন্তর্ভুক্ত ভুক্তিগুলো সুবিন্যস্ত হতে হয়, যাতে পাঠকসমাজ দ্রুত এবং অল্প আয়াসে কোনো বিষয়ের তথ্য খুঁজে পায়।
- বিভিন্ন বিষয় সন্নিবেশের কারণে বিশ্বকোষ আয়তনে অনেক বড় হয়ে থাকে। কখনো অনেকগুলো খণ্ডে প্রকাশিত হয়। এটি কোষগ্রন্থসমূহের মধ্যে সবচেয়ে বৃহৎ।
- বিশ্বকোষের তথ্যাবলি নির্ভরযোগ্য বিভিন্ন সূত্র থেকে সংগ্রহ করতে হয়। এ ক্ষেত্রে সংগ্রাহকদের সতর্কতার সাথে দায়িত্ব পালন করা অপরিহার্য। কারণ, নির্ভরযোগ্যতা বিশ্বকোষের একটি গুরুত্বপূর্ণ বৈশিষ্ট্য।
- পরিবর্তিত তথ্যের আলোকে বিশ্বকোষকে নিয়মিত হালনাগাদ করতে হয়। তা না হলে এটি গুরুত্বহীন হয়ে পড়ে। তাই বিশ্বকোষের কাজ শেষ হয়েছে বলে কখনো ভাবা যায় না।
বিশ্বকোষের প্রকারভেদ
শব্দকোষের মতো বিশ্বকোষেরও প্রকারভেদ রয়েছে। বেশ কয়েক রকমের বিশ্বকোষ দেখা যায়।
বিষয়ের ব্যাপকতার দিক থেকে বিশ্বকোয় দুই প্রকার। যেমন: ১. সাধারণ বিশ্বকোষ ও ২. বিষয়ভিত্তিক বিশ্বকোষ।
আবার প্রকাশের মাধ্যম বিবেচনায় বিশ্বকোষ দুই ধরনের। যেমন: ১. মুদ্রিত বিশ্বকোষ ও ২. ডিজিটাল বিশ্বকোষ।
প্রতিষ্ঠানের অধীনে নির্ধারিত বিশেষজ্ঞ কর্তৃক ছাড়াও আরো এক ধরনের বিশ্বকোষ রয়েছে, যা স্বেচ্ছাসেবী লেখকরা সংকলন করেন।
নিচে কয়েক প্রকার বিশ্বকোষ সম্পর্কে আলোচনা করা হলো।
সাধারণ বিশ্বকোষ
সাধারণ বিশ্বকোষে বিষয়ের ব্যাপকতা থাকে। সংশ্লিষ্ট বিষয়ের বিশেষজ্ঞগণ এই বিশ্বকোষের ভুক্তিতে কাজ করেন।
তাঁদের লেখা নাতিদীর্ঘ নিবন্ধের মাধ্যমে একেকটি বিষয়ের আলোচনা বা তথ্য তুলে ধরা হয়।
নওরোজ কিতাবিস্তানের বাংলা বিশ্বকোষ এবং এনসাইক্লোপিডিয়া ব্রিটানিকা এ ধরনের বিশ্বকোষ।
বিষয়ভিত্তিক বিশ্বকোষ
সাধারণ বিশ্বকোষে প্রদত্ত কোনো নির্দিষ্ট বিষয়ে বর্ণনা ছাড়াও আরো গভীর ধারণা পাওয়ার জন্য বিষয়ভিত্তিক বিশ্বকোষ ব্যবহারের প্রয়োজন হয়।
বিষয়ভিত্তিক বিশ্বকোষগুলো কেবল এই বিষয় সম্পর্কিত হয়ে থাকে। যেমন: আইনকোষ, অর্থনীতিকোষ, এনসাইক্লোপিডিয়া অব ল্যাঙ্গুয়েজ অ্যান্ড লিঙ্গুইস্টিকস ইত্যাদি।
ডিজিটাল বিশ্বকোষ
প্রযুক্তির প্রসার ও উৎকর্ষের যুগে অনেকেই মুদ্রিত বিশ্বকোষের পরিবর্তে কম্পিউটার বা মুঠোফোনে বিশ্বকোষ ব্যবহার করে থাকে।
এগুলোকে ডিজিটাল বিশ্বকোষ বলে। একে বৈদ্যুতিক বিশ্বকোষও বলা হয়।
নওরোজ কিতাবিস্তানের বাংলা বিশ্বকোষ এবং এ ধরনের বিশ্বকোষ হালনাগাদ রাখা সহজ।
স্বেচ্ছাসেবী লেখকদের বিশ্বকোষ
ইন্টারনেটে কিছু বিশ্বকোষ রয়েছে, যা স্বেচ্ছাশ্রমে সংকলিত হয়।
পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্ত থেকে স্বেচ্ছাসেবী লেকখগণ অনলাইনে বিশ্বকোষকে সমৃদ্ধ করেন।
উইকিপিডিয়া এই শ্রেণির বিশ্বকোষ।
বিশ্বকোষের ভুক্তি
বিশ্বকোষে নানা ধরনের বিষয় নিয়ে সংক্ষিপ্ত আকারে লেখা নিবন্ধ সংকলিত হয়। এগুলোকে বলা হয় ভুক্তি।
বিশ্বকোষের ভুক্তি অভিধানের চেয়ে আলাদা হয়ে থাকে। সাধারণ অভিধানে একটি শব্দের ব্যুৎপত্তি, উচ্চারণ, সংজ্ঞা, বাক্যে প্রয়োগ ইত্যাদি থাকে।
কিন্তু বিশ্বকোষের ভুক্তিগুলো দীর্ঘ হয়। বর্ণনা ও ভাবগত বিবেচনায় এর ব্যাপ্তি অভিধানের চেয়ে অনেকটা বেশি।
বিষয়ের শিরোনাম সম্পর্কিত তথ্য নিয়ে রচিত নিবন্ধই বিশ্বকোষের ভুক্তি। ভুক্তির মধ্যে প্রয়োজন অনুসারে মানচিত্র, সারণি, ছবি, পরিসংখ্যান বা গ্রন্থপঞ্জিও অন্তর্ভুক্ত হতে পারে।
অধিকাংশ বিশ্বকোষে ভুক্তি রচয়িতার নাম ভুক্তির নিচে সংযুক্ত থাকে। ভুক্তির মধ্যে কিছু শব্দ বা শব্দগুচ্ছ আলাদাভাবে চিহ্নিত করা হয়।
এর অর্থ, এই শব্দ বা শব্দগুচ্ছ দিয়ে আলাদা ভুক্তি রয়েছে। সেসব ভুক্তি পাঠ করে প্রয়োজনে পাঠক নির্দিষ্ট বিষয়ে পরিষ্কার ধারণা লাভ করতে পারেন।
অনলাইন বিশ্বকোষে এগুলো ভিন্ন রঙের হয় এবং তাতে ক্লিক করলে সে বিষয়ের আলোচনা সামনে চলে আসে।
পৃথিবী বিখ্যাত কিছু বিশ্বকোষ
বিশ্বকোষের চর্চা হচ্ছে প্রায় দুই হাজারবছর ধরে। তবে সেগুলো প্রকাশের কোনো ব্যবস্থা ছিল না।
আঠারো শতকের মাঝামাঝি সময়ে কয়েকজন ফরাসি পণ্ডিত Encyclopedia নামে গ্রন্থমালা প্রকাশ করেন।
তাদের উদ্দেশ্য ছিল, পৃথিবীতে যে জ্ঞান ছড়িয়ে আছে, তা সংগ্রহ ও সুবিন্যস্ত করে সমকালীন পাঠক এবং ভবিষ্যৎ প্রজন্মের কাছে পৌঁছে দেওয়া।
এরপর ইংরেজি বিশ্বকোষ ‘এনসাইক্লোপিডিয়া ব্রিটানিকা‘ প্রকাশিত হয় ১৭৬৮-১৭৭১ সালে।
এটি ৩২ খণ্ডে মুদ্রিত বই হিসেবে ও অনলাইনে তাদের নিজস্ব ওয়েবসাইটে পাওয়া যায়।
এর বাইরেও অনুসন্ধানী পাঠকদের কাছে আরো অনেক জনপ্রিয় বিশ্বকোষ রয়েছে। যেমন: ‘এনসাইক্লোপিডিয়া আমেরিকানা’, ‘চেম্বার্স এনসাইক্লোপিডিয়া’, ‘কলিয়ার্স এনসাইক্লোপিডিয়া’, এভরিম্যানস এনসাইক্লোপিডিয়া’ ইত্যাদি।
বাংলা ভাষায় রচিত বিশ্বকোষ
বাংলা ভাষায় জ্ঞানকোষ রচনার প্রথম উদ্যোগ নেন উইলিয়াম কেরির পুত্র ফেলিক্স কেরি।
এনসাইক্লোপিডিয়া ব্রিটানিকা অবলম্বনে তিনি বিদ্যাহারাবলী নামক জ্ঞানকোষ রচনার কাজ শুরু করেন।
তার উদ্যোগ যথেষ্ট গুরুত্বপূর্ণ হলেও বাংলা ভাষায় যথার্থ বিশ্বকোষ হলো নগেন্দ্রনাথ বসু সংকলিত বিশ্বকোষ।
এর প্রথম খণ্ড সংকলন করেন রজালাল মুখোপাধ্যায় ও ত্রৈলোক্যনাথ মুখোপাধ্যায়। দ্বিতীয় খণ্ড থেকে ২২তম খণ্ড পর্যন্ত সংকলন করেন নগেন্দ্রনাথ বসু।
১৮৮৬ সালে এই বিশ্বকোষের কাজ শুরু হয় এবং শেষ হয় ১৯১১ সালে।
এ ছাড়া ভারতকোষ নামে বাংলা ভাষায় সংকলিত আরো একটি উল্লেখযোগ্য বিশ্বকোষ। ১৮৮১ থেকে ১৮৯২ সালের মধ্যে এটি রাজকৃষ্ণ রায় ও শরচ্চন্দ্র দেব কর্তৃক সংকলিত হয়।
বাংলাদেশে বাংলা একাডেমি, এশিয়াটিক সোসাইটি ও প্রকাশনা প্রতিষ্ঠানের মধ্যে নওরোজ কিতাবিস্তান এবং মুক্তধারা বিশ্বকোষ নিয়ে কাজ করেছে।
বাংলা একাডেমি থেকে প্রকাশিত বিশ্বকোষ গ্রন্থমালার মধ্যে বাংলা একাডেমি বিজ্ঞান বিশ্বকোষ উল্লেখযোগ্য। আয়তন, ভুক্তিসমূহের বিন্যাস এবং ব্যবহার-যোগ্যতার বিবেচনায় এটি একটি অত্যন্ত সফল প্রয়াস।
নওরোজ কিতাবিস্তান ও মুক্তধারা থেকে প্রকাশিত চার খণ্ডে সংকলিত ‘বাংলা বিশ্বকোষ’ (১৯৭২ থেকে ১৯৭৪ পর্যন্ত) একটি সুপরিকল্পিত গ্রন্থ। এই বিশ্বকোষ ‘কলাম্বিয়া ভাইকিং ডেস্ক এনসাইক্লোপিডিয়া’ অবলম্বনে রচিত।
এশিয়াটিক সোসাইটি থেকে প্রকাশিত বাংলাপিডিয়া বাংলাদেশে বিশ্বকোষ চর্চায় এ-যাবৎকালের শ্রেষ্ঠ পদক্ষেপ।
বাংলাপিডিয়া বর্তমানে ১৪ খণ্ডে পাওয়া যায়। এর কম্পিউটারে ব্যবহারের উপযোগী সংস্করণ ও অনলাইন সংস্করণও রয়েছে।
এ ছাড়া বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান থেকে আরো কিছু বাংলা কোষগ্রন্থ প্রকাশিত হয়েছে।
অবশ্যই পড়ুন:
- মোবাইল থেকে ইমেইলে ছবি পাঠানোর নিয়ম
- ছবির সাথে গান লাগানোর সেরা ১০টি সফটওয়্যার/অ্যাপস
- কিভাবে ইউটিউব থেকে টাকা আয় করা যায় ?
- অনলাইন থেকে ভোটার আইডি কার্ড ডাউনলোড করার নিয়ম
- নতুন আইডি কার্ড দেখার নিয়ম
বিশ্বকোষের প্রয়োজনীয়তা
বিশ্বকোষ একটি স্বয়ংসম্পূর্ণ জ্ঞানভাণ্ডার। জ্ঞান-বিজ্ঞানের সকল শাখায় নানাবিধ রচনা সংকলিত থাকে বিশ্বকোষ গ্রন্থমালায়।
বিশ্বের মানুষ যা কিছু চর্চা করে, তার সবই বিশ্বকোষের অন্তর্ভুক্ত হয়। এটি একটি চলমান প্রক্রিয়া। পরিবর্তিত তথ্যের আলোকে বিশ্বকোষকে নিয়মিত হালনাগাদ করতে হয়। হালনাগাদ বলেই বিশ্বকোষ বিভিন্ন শাখায় সকলের জানা ও জ্ঞানের চাহিদা মেটাতে সক্ষম।
সুতরাং মানুষের পার্থিব জীবনে বিশ্বকোষের প্রয়োজনীয়তা অপরিসীম।
উপসংহার
বিশ্বের যাবতীয় শৃঙ্খলার ধারণাসমূহ কোনো একজন ব্যক্তির পক্ষে ধারণ করা সম্ভব নয়। এমনকি একটি নির্দিষ্ট জ্ঞানশাখার প্রতিটি বিষয়ও কারো একার পক্ষে জানা অসম্ভব।
প্রত্যেকের অর্জিত জ্ঞান ও অভিজ্ঞতাকে এক জায়গায় বিন্যস্ত করে সবার জন্য উন্মুক্ত করে দেওয়া বিশ্বকোষের প্রধান লক্ষ্য।
কোষগ্রন্থসমূহের মধ্যে বিশ্বকোষ শুধু আয়তনেই বড় নয়, জ্ঞানচর্চার এক বিপুল ভাণ্ডারও। তাই প্রতিটি ভাষায় বিশ্বকোষ থাকা অপরিহার্য।
তাহলে বিশ্বকোষ কি বা বিশ্বকোষ কাকে বলে এবং বিশ্বকোষের ইতিহাস, বৈশিষ্ট্য ও প্রকারভেদ আশা করি আজকের আর্টিকেলের মাধ্যমে আপনারা জানতে পেরেছেন।
বিশ্বকোষ কি: FAQ
জ্ঞান-বিজ্ঞানের বিচিত্র বিষয় নিয়ে সংকলিত গ্রন্থ বা গ্রন্থমালাই বিশ্বকোষ।
বাংলায় বিশ্বকোষ শব্দটি ইংরেজি প্রতিশব্দ এনসাইক্লোপিডিয়া (Encyclopedia)।
এনসাইক্লোপিডিয়া ব্রিটানিকা হলো প্রাচীনতম ইংরেজি ভাষার সাধারণ বিশ্বকোষ। ১৯৬৮ সালে এনসাইক্লোপিডিয়া ব্রিটানিকা প্রথম প্রকাশিত হয়।
পৃথিবীর সবচেয়ে বড় মুক্ত বিশ্বকোষ হলো উইকিপিডিয়া (Wikipedia)