মানবদেহের বৈদ্যুতিক চার্জ আমাদের দৈনন্দিন জীবনে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। আমরা সাধারণত বৈদ্যুতিক চার্জ বলতে বিদ্যুৎবাহী তারের মাধ্যমে যে শক্তি প্রবাহিত হয় তা বুঝে থাকি, কিন্তু আমাদের দেহেও প্রাকৃতিকভাবে বৈদ্যুতিক চার্জ থাকে যা আমাদের শরীরের বিভিন্ন কার্যাবলীতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। এই প্রবন্ধে, আমরা মানবদেহের বৈদ্যুতিক চার্জের সম্পর্কে কিছু অজানা তথ্য ও বৈজ্ঞানিক বিশ্লেষণ তুলে ধরব।
১. মানবদেহে বৈদ্যুতিক চার্জের উৎস
মানবদেহের বৈদ্যুতিক চার্জ মূলত আসে আমাদের দেহের কোষ থেকে। প্রতিটি কোষের ভেতরে ও বাইরে কিছু আয়ন থাকে, যেমন সোডিয়াম (Na⁺), পটাসিয়াম (K⁺), ও ক্লোরাইড (Cl⁻)। এই আয়নগুলোর মাধ্যমে কোষের ভেতর ও বাইরে বৈদ্যুতিক পার্থক্য সৃষ্টি হয়, যা বৈদ্যুতিক চার্জের মূল উৎস।
২. স্নায়ুতন্ত্রের বৈদ্যুতিক সিগন্যাল
আমাদের স্নায়ুতন্ত্র বৈদ্যুতিক সিগন্যালের মাধ্যমে কাজ করে। যখন কোনো স্নায়ুকোষ সক্রিয় হয়, তখন সে একটি বৈদ্যুতিক সংকেত সৃষ্টি করে যা দ্রুত অন্য স্নায়ুকোষ বা পেশীতে প্রেরিত হয়। এই বৈদ্যুতিক সংকেতের মাধ্যমেই আমাদের দেহের বিভিন্ন অঙ্গপ্রত্যঙ্গের মধ্যে সমন্বয় সাধন করা হয়।
৩. হৃদযন্ত্রের বৈদ্যুতিক কার্যকলাপ
হৃদযন্ত্র একটি নির্দিষ্ট ধরণের বৈদ্যুতিক সংকেতের মাধ্যমে কাজ করে। এই সংকেতের মাধ্যমেই হৃদযন্ত্রের পেশীগুলো সংকুচিত ও বিস্তৃত হয়, যা রক্ত সঞ্চালনের জন্য প্রয়োজনীয়। যদি এই বৈদ্যুতিক সংকেতের প্রক্রিয়া কোনো কারণে ব্যাহত হয়, তবে হৃদযন্ত্রের কাজ বন্ধ হয়ে যেতে পারে।
৪. ইলেক্ট্রোলাইটের ভূমিকা
মানবদেহের বৈদ্যুতিক চার্জ নিয়ন্ত্রণে ইলেক্ট্রোলাইট গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। ইলেক্ট্রোলাইট হলো দেহে বিদ্যমান খনিজ পদার্থ যা বিদ্যুৎ পরিবহন করে। সোডিয়াম, পটাসিয়াম, ক্যালসিয়াম, ও ম্যাগনেসিয়াম হলো প্রধান ইলেক্ট্রোলাইট যা মানবদেহের বৈদ্যুতিক চার্জের ভারসাম্য বজায় রাখতে সাহায্য করে।
আরো পড়ুন
টুনামাছ(Tuna Fish): সমুদ্রের অদ্ভুত দান
৫. স্ট্যাটিক ইলেকট্রিসিটি এবং মানবদেহ
স্ট্যাটিক ইলেকট্রিসিটি বা স্থির বিদ্যুৎ একটি পরিচিত ফেনোমেনা। কখনও কখনও আমরা দেহের উপর স্ট্যাটিক চার্জ জমা হতে দেখি, যা আমাদের দৈনন্দিন কাজের সময় ঘটে। এটি মূলত ঘটে যখন আমরা দুটি ভিন্ন ধরনের পদার্থের সংস্পর্শে আসি, এবং একটি পদার্থ থেকে ইলেকট্রন স্থানান্তরিত হয় অন্য পদার্থে।
৬. চৌম্বকীয় ক্ষেত্র এবং দেহের বৈদ্যুতিক চার্জ
বৈদ্যুতিক চার্জের পাশাপাশি মানবদেহে চৌম্বকীয় ক্ষেত্রও উপস্থিত থাকে। বিশেষ করে, মস্তিষ্কের বৈদ্যুতিক কার্যকলাপের ফলে ক্ষুদ্র চৌম্বকীয় ক্ষেত্র সৃষ্টি হয়, যা ম্যাগনেটোএনসেফালোগ্রাফি (MEG) মেশিনের মাধ্যমে মাপা যায়।
৭. থেরাপিউটিক প্রয়োগ
মানবদেহের বৈদ্যুতিক চার্জ থেরাপিউটিক প্রয়োগেও ব্যবহৃত হয়। ইলেক্ট্রোথেরাপি, ট্রান্সক্রেনিয়াল ম্যাগনেটিক স্টিমুলেশন (TMS) ইত্যাদি চিকিৎসা পদ্ধতিতে বৈদ্যুতিক চার্জ ব্যবহার করে নির্দিষ্ট রোগের চিকিৎসা করা হয়।
মানবদেহের বৈদ্যুতিক চার্জ নিয়ে আমাদের জানার পরিধি অনেক গভীর এবং বৈচিত্র্যময়। আমাদের দেহের প্রতিটি ক্রিয়াকলাপের সাথে এটি অঙ্গাঅঙ্গিভাবে জড়িত। বৈদ্যুতিক চার্জের এই বিস্ময়কর বৈশিষ্ট্য সম্পর্কে আরো গবেষণা আমাদের দেহের বিভিন্ন প্রক্রিয়ার গভীরতর বোঝাপড়া এবং চিকিৎসা ক্ষেত্রে নতুন দিগন্ত উন্মোচন করতে পারে।